জাকির,ডিমলা-নীলফামারী প্রতিনিধিঃ বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ এর কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য,সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট ও চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি আজীবন বিপ্লবী কমরেড জাহেদুল হক মিলু’র দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ নীলফামারী জেলা শাখার উদ্যোগে
২৬ জুন বেলা ১১ টায় নিরপদ দুরত্ব বজায় রেখে কমরেড ইউনুছ আলীর বাসভবনে স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
নীলফামারী জেলা বাসদের আহ্বায়ক কমরেড ইউনুছ আলীর সভাপতিত্বে,
স্মরণ সভার শুরুতে কমরেড মিলু’র স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নিরাবতার পালন করা হয়।
সভায় প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাসদ রংপুর জেলা আহ্বায়ক কমরেড আব্দুল কুদ্দুস।আরো আলোচনা করেন নীলফামারী জেলা বাসদ সদস্য হামিদুল ইসলাম,পরিমল রায়,নিরাঞ্জন রায়,দীপংকর শর্মা,জয়পুরহাট জেলা ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রাশেদুজ্জামান রাশেদ,নীলফামারী জেলা ছাত্র ফ্রন্টের সংগঠক ও ডিমলা উপজেলার সভাপতি জাকির হোসেন,ডিমলা উপজেলার সাংগঠনিক সম্পাদক মহেন রায় সহ জেলা বাসদ ও ছাত্র ফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ।
স্মরণ সভায় নেতৃবৃন্দ বলেনঃ ১৯৭১-এ মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাক্কালে পাকিস্তানি শোষণ-দুঃশাসন-নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনে যখন দেশের সকল শ্রেণিপেশার মানুষ প্রতিরোধে যুক্ত হয়ে গণ-আন্দোলন গণ-প্রতিরোধ গড়ে তোলে, যা একপর্যায়ে গণ।-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়, তখন একজন স্কুল পড়ুয়া ছাত্র হয়েও তাতে তিনি শামিল হন এবং অবিভক্ত ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। এই সংগ্রামে ছাত্রদের যুক্ত করার তাগিদ তিনি অনুভব করেন। ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন শাসকরা জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে শুরু করে তখন এর বিরুদ্ধে ১৯৭২ সালে গড়ে ওঠা ছাত্র সংগঠন জাসদ ছাত্রলীগে তিনি যোগ দেন এবং তৎকালীন কুড়িগ্রাম মহাকুমা’র প্রথম কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, পরবর্তীতে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালনে ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন। ছাত্র রাজনীতি উত্তরসময়ে তিনি জাসদ রাজনীতিতে যুক্ত হন। ওই সময় শাসক দল আওয়ামী লীগ সারা দেশে জাসদের নেতাকর্মীদের ওপর ব্যাপক দমনপীড়ন চালায়, হত্যা করে এবং নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেফতার করে, কারাগারে নিক্ষেপ করে। কমরেড মিলু প্রথমে ১৯৭২ সালে এবং পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে মোট তিনবার গ্রেফতার হয়ে প্রায় চার বছর কারাভোগ করেন।
১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর বাসদ প্রতিষ্ঠার পর কমরেড জাহেদুল হক মিলু কুড়িগ্রাম মহাকুমার সমন্বয়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং নিষ্ঠার সাথে তা পালন করেন। আইনের ডিগ্রি নিয়েও তিনি আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেননি। দলের প্রয়োজনে নিজেকে একজন পেশাদার বিপ্লবী হিসেবে গড়ে তোলার সংগ্রামে নিয়োজিত হন। দলের নির্দেশে তিনি ১৯৮৭ সাল থেকে ৮৯ সাল পর্যন্ত বাসদ বগুড়া জেলা শাখার সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় তিনি এরশাদের সামরিক-স্বৈরাশাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে কুড়িগ্রামে দলের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে বাসদের কুড়িগ্রাম জেলা সম্মেলনে তিনি দলের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন এবং একই বছর অনুষ্ঠিত দলের কেন্দ্রীয় কনভেনশনে কেন্দ্রীয় কমিটিরও সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ২০০৩ সালে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, পরবর্তীতে সহ-সভাপতি ও মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। একই সাথে তিনি ‘চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’র সভাপতির দায়িত্ব ও পালন করেন। শ্রমিক আন্দোলনের জোট ‘শ্রমিক কর্মচারী ঐক্যপরিষদ’ স্কপ-এর তিনি কেন্দ্রীয় দায়িত্ব পালন করেন। আন্তর্জাতিক পরিসরে গড়ে ওঠা শ্রমিক সংগঠন ‘বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন’-এর অন্তর্ভুক্ত ফেডারেশন শ্রমিক ফ্রন্টের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি WFTU বাংলাদেশ কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি কুড়িগ্রাম জেলা বার-এর সদস্য, কুড়িগ্রাম মটর শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা, কুড়িগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির সদস্য, কুড়িগ্রাম ‘স’ মিল’স শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা, রিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন, হোটেল শ্রমিক ইউনিয়ন ও নির্মাণশ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন এবং ৮০’র দশকে স্থানীয় পত্রিকায় কলাম লিখতেন।
২০১৮ সালের ১২ মে রাতে সাংগঠনিক কাজে কমরেড মিলু ঢাকা থেকে কুড়িগ্রাম যান, ১৩ মে সকালে উলিপুর থেকে জেলা সদরে ফেরার পথে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারাত্মক আহত হন। প্রথমে তাঁকে কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়, সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। রংপুরের ডাক্তারদের পরামর্শে ১৪ মে সেখান থেকে এয়ার এ্যাম্বুলেন্সযোগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় এবং ১৫ মে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। পরবর্তীতে ১৭ মে আরও নিবিড় পরিচর্যা ও উন্নত চিকিৎসার্থে তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। দীর্ঘ ৩২ দিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে ১৩ জুন ২০১৮ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তাঁর চরিত্রের অনেকগুলো দৃষ্টান্তমূলক গুণ ছিলো। যেমন, উন্নত সংস্কৃতির অধিকারী না হলে মানুষ অন্যের সমালোচনা সহজে গ্রহণ করতে পারে না; প্রবলভাবে বুর্জোয়া ব্যক্তিবাদের শিকার হয়। কোনো মানুষই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়, তিনিও ভুলের ঊর্ধ্বে ছিলেন না। এর মধ্যে সংগ্রামের দিকটাই ছিলো তার বড়, যা আমরা তার যাপিত জীবনে দেখতে পাই।
নেতৃবৃন্দ আরো বলেন কমরেড জাহেদুল হক মিলু’র দেহের মৃত্যু হলেও তার চেতনা,স্বপ্ন যুগ যুগ ধরে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবে।তার স্বপ্ন ছিলো শোষণহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। তার এই চেতনাকে ধারন করে আমরা আজীবন শোষণহীন সমাজ তথা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাবো।